এ দু’ সাক্ষ্য ইসলামে প্রবেশ পথ ও তার মহান স্তম্ভ। কোনো ব্যক্তি মুসলিম হতে পারবে না যতক্ষণ না সে এ দু’ সাক্ষ্য মুখে উচ্চারণ করবে ও সাক্ষ্যদ্বয়ের দাবী অনুযায়ী আমল করবে।
আর এ সাক্ষ্য দানের মাধ্যমেই এক কাফির মুসলিম হয়ে যায়।
১- আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই এ সাক্ষ্য দানের অর্থ: এর অর্থ জেনে তা মুখে উচ্চারণ করা, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে এর দাবী ও চাহিদা অনুযায়ী আমল করা।
Table of Contents
বস্তুত এর অর্থ না জেনে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল না করে শুধু মুখে পাঠ করা সকলের ঐকমত্যে কোনো উপকারে আসে না। বরং তার বিরূদ্ধে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে।
আর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থ হলো: এক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা ছাড়া কোনো সত্য মা‘বুদ নেই।
এ কালেমার দু’টি রুকন (অঙ্গ) রয়েছে:
১- না-বাচক অঙ্গ; (অস্বীকৃতি জানানো আর ২- হ্যাঁ-বাচক অঙ্গ (স্বীকৃতি জানানো):
আল্লাহ ছাড়া সব কিছুর উপাসনা অস্বীকার করা এবং সে উপাসনা একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা, যার কোনো অংশীদার নেই। তাগুতকে অস্বীকার করাও এ কালেমার অন্তর্ভুক্ত।
তাগুত-হলো, আল্লাহ ছাড়া মানুষ, পাথর, বৃক্ষ ও প্রবৃত্তি ইত্যাদি যা কিছুর পূজা-উপাসনা করা হয় আর সে উপাস্য তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
মূলতঃ তাগুতকে ঘৃণা করা ও তা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করাও এ কালেমার অর্থের অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, যে ব্যক্তি এ কালেমা মুখে উচ্চারণ করেছে অথচ আল্লাহ ছাড়া যে সকল বস্তুর ইবাদাত করা হয় তা অস্বীকার করে নি সে এ কালেমার দাবী পূরণ করে নি।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣ البقرة: ١٦٣
“তোমাদের ইলাহ-উপাস্য হলেন এক ও অদ্বিতীয় আর সে মহান করুণাময় দয়ালু ব্যতীত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ- উপাস্য নেই।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৬৩]
তিনি আরো বলেন,
لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦ البقرة: ٢٥٦
“দীনে প্রবেশ করানোর ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নাই, সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে সে এমন এক মজবূত হাতল ধরবে যাহা কখনও ভাঙ্গবে না। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৬]
আর ইলাহ-এর অর্থ: মা‘বুদ-উপাস্য। কেউ যদি এ বিশ্বাস করে যে ইলাহ অর্থ সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা বা নতুন কিছু আবিস্কারে ক্ষমতাশীল, আর সে যদি মনে করে যে এ বিশ্বাসই যথেষ্ট, যদিও সে সকল ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না করে- সে ব্যক্তির ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ দুনিয়াতে কোনো উপকারে আসবে না, আর আখিরাতে স্থায়ী শাস্তি হতে এ কালেমা তাকে মুক্তিও দিবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ يونس : ٣١
“বল, কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী হতে জীবনোপকরণ সরবরাহ করে অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি কার কর্তৃত্বাধীন? কে জীবিতকে মৃত থেকে নির্গত করে এবং কে মৃতকে জীবিত থেকে নির্গত করে এবং কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে? তখন তারা বলবে, আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩১]
তিনি আরো বলেন,
وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ فَأَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ ٨٧ الزخرف: ٨٧
“যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তবুও তারা কোথায় ফিরছে?” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৭]
২- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এ সাক্ষ্য দানের অর্থ:
(ক) “নিশ্চয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল” এ সাক্ষ্য দানের অর্থ হলো,
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আদেশ করেছেন তা পালন করা,
- তিনি যে সব খবর দিয়েছেন তা সত্য বলে বিশ্বাস করা
- তিনি যে সব বিষয় সম্পর্কে নিষেধ ও সতর্ক করেছেন সেগুলি থেকে বিরত থাকা
- আর একমাত্র তিনি যে বিধান দান করেছেন সেটা অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদাত করা।
(খ) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এ সাক্ষ্য বাস্তবায়ন:
- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এ সাক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে ঈমান ও পূর্ণ ইয়াকীন দ্বারা।
- নিশ্চয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল; যাকে সকল মানব ও জিন্ন জাতির নিকট প্রেরণ করেছেন।
- তিনি শেষ নবী ও রাসূল।
- নিশ্চয় তিনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারী বান্দা। তাঁর মাঝে উলুহিয়্যাতের কোনো বৈশিষ্ট নেই।
- তাঁর অনুসরণ করা, তাঁর আদেশ নিষেধের সম্মান করা।
- কথায়, কাজে ও বিশ্বাসে তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا﴾ [الاعراف: ١٥٨]
“বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا ٢٨﴾ [سبا: ٢٨]
“আমরা তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি”। [সূরা সাবা, আয়াত: ২৮]
তিনি আরো বলেন,
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّۧنَ ٤٠﴾ [الاحزاب : ٤٠]
“মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নহে, বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
তিনি আরো বলেন,
﴿قُلۡ سُبۡحَانَ رَبِّي هَلۡ كُنتُ إِلَّا بَشَرٗا رَّسُولٗا ٩٣﴾ [الاسراء: ٩٣]
“বল, আমার রব পবিত্র! আমি কেবল একজন মানুষ যাকে রাসূল বানানো হয়েছে”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৯৩]
উক্ত সাক্ষ্য নিম্নেবর্ণিত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে:
প্রথমত: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের স্বীকৃতি দেওয়া ও অন্তরে তার বিশ্বাস রাখা।
দ্বিতীয়ত: কালেমার এ অংশের উচ্চারণ করা ও মুখের দ্বারা প্রকাশ্যভাবে এর স্বীকৃতি দেওয়া।
তৃতীয়ত: যে সত্য তিনি নিয়ে এসেছেন তা অনুসরণ করা এবং যে বাতিল বিষয়সমূহ থেকে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فََٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ ٱلنَّبِيِّ ٱلۡأُمِّيِّ ٱلَّذِي يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَكَلِمَٰتِهِۦ وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٥٨﴾ [الاعراف: ١٥٨]
“সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর বার্তাবাহক উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে ঈমান আনে এবং তোমরা তাঁর অনুসরণ কর যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হতে পার”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]
চতুর্থত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব খবর দিয়েছেন তা সত্য বলে বিশ্বাস করা।
পঞ্চমত: জান-মাল, ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা ও সকল মানুষের ভালোবাসার চাইতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক ভালোবাসা। কারণ, তিনি আল্লাহর রাসূল আর তাঁকে ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার অন্তর্ভুক্ত।
আর তাঁর প্রকৃত মুহাব্বাত হলো তাঁর আদেশসমূহের আনুগত্য করে তাঁর নিষেধসমূহ থেকে বিরত থেকে তাঁর অনুসরণ করা। তাঁকে সাহায্য করা, তার সাথে বন্ধুত্ব রাখা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ ٣١﴾ [ال عمران: ٣١]
“বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين»
“তোমাদের কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে ও সকল মানুষের চেয়ে অধিকতর প্রিয় না হবো”।[1]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِهِۦ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُواْ ٱلنُّورَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ مَعَهُۥٓ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٥٧﴾ [الاعراف: ١٥٧]
“সুতরাং যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং যে নূর তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে সেটার অনুসরণ করে তাঁরাই সফলকাম”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭]
ষষ্টত: তাঁর সুন্নাতের ওপর আমল করা। তাঁর কথাকে সকলের কথার ওপর প্রাধান্য দেওয়া, নির্দ্বিধায় তা গ্রহণ করা। তাঁর শরী‘আত মোতাবেক বিধান পরিচালনা করা এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء : ٦٥]
“কিন্ত না, তোমার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সন্ধন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে না নেয়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]